বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূচনা যাঁর হাতে, সেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে সরাসরি পরিচয়ের কোনো তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে মাইকেলের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মধুসূদনের সম্পর্ক ছিল অন্তরঙ্গ। এছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মাইকেলের সৌহার্দ্যপূর্ণ সময় কেটেছিল দেশ ও বিদেশে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থে স্মরণ করেছেন, “মাইকেল মধুসূদন দত্ত তখন আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসিতেন… তিনি অতিশয় সহৃদয়, আমুদে এবং মজলিশি ব্যক্তি ছিলেন। গল্প করিয়া লোককে মুগ্ধ করিবার শক্তি তাঁহার অপূর্ব ও অসাধারণ ছিল।”
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যখন মধুসূদন তার মেঘনাদবধ কাব্য আবৃত্তি করছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ মাতৃগর্ভে। ১৮৬১ সালের জানুয়ারিতে কাব্যের প্রথম খণ্ড এবং এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। সেই বছরই জন্ম নেন রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ও শ্রেষ্ঠ কবি—দুজনেই একই বছরের দুই আশ্চর্য নিদর্শন।
মধুসূদনের কাব্যকীর্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রভাবে ঠাকুরবাড়ির পাঠচক্রে মেঘনাদবধ কাব্য ছিল গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথের ভাই হেমেন্দ্রনাথ পরিবারের মেয়েদের এই কাব্য পড়াতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির গৃহশিক্ষক নীলকমল ঘোষাল, যিনি ছিলেন নর্মাল স্কুলের শিক্ষক, মেঘনাদবধ পড়াতেন রবীন্দ্রনাথকে শিশুকালে।
কিন্তু এই পাঠ আনন্দের বদলে হয়ে ওঠে একরকম যন্ত্রণা। পরিণত বয়সে ‘ছেলেবেলা’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মেঘনাদবধ কাব্যটিও আমাদের পক্ষে আরামের জিনিস ছিল না।… ভালো কাব্যকে ভাষাশিক্ষার যন্ত্র বানালে, তরবারি দিয়ে ক্ষৌরি করানোর মতো অবস্থা হয়।”
এই বিরূপ অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় মধুসূদনের কাব্যের প্রতি একপ্রকার অনাগ্রহ। ষোলো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ মেঘনাদবধ নিয়ে লেখেন, “দেখিলাম তাহার প্রাণ নাই, তাহা মহাকাব্যই নয়।”
একুশ বছর বয়সেও এই সমালোচনা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন, তা ছিল “অল্প বয়সের স্পর্ধা”। ১৯১২ সালে তিনি লজ্জিত কণ্ঠে লেখেন, “আমি এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম।”
যোগীন্দ্রনাথ বসুর তীব্র প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ আরও অনুতপ্ত হন এবং লেখেন, “সমালোচক যে পঞ্চদশ বর্ষীয় বালক ছিল, তা তিনি যদি জানিতেন তবে এমন দীর্ঘ প্রতিবাদ করতেন না।”
এমন আন্তরিক আত্মসমালোচনা একজন মহৎ প্রতিভার পক্ষেই সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ পরে মেঘনাদবধ কাব্য ও মধুসূদনের অন্য রচনার মধ্যে যে বিদ্রোহ, সৌন্দর্য ও গীতিকবিতার প্রকাশ পেয়েছিলেন, তা তিনি স্পষ্ট করে বলেন। চতুর্দশপদী কবিতাবলী, বীরাঙ্গনা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য ইত্যাদির প্রতি তার অনুরাগ ছিল স্পষ্ট। তাঁর বাংলা কাব্য পরিচয় গ্রন্থে মধুসূদনের ছয়টি কবিতা স্থান পেয়েছিল, যা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন।
মধুসূদনের কাব্যভাষা, ছন্দচ্যুতি ও পৌরাণিক চরিত্রে বিদ্রোহের যে ধারা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, তা তিনি বর্ণনা করেন এভাবে:
“মধুসূদন কেবল ছন্দোবন্ধে নয়, রচনার ভাব ও রসের মধ্যেও একটি অপূর্ব পরিবর্তন এনেছেন।… পয়ারের বেড়ি ভাঙিয়াছেন এবং রাম-রাবণের প্রচলিত সম্বন্ধ ভাঙিয়াছেন… বিদায়কালে কাব্য লক্ষ্মী নিজের অশ্রুসিক্ত মালা তাহারই গলায় পরাইয়া দিল।”
শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা নিয়েছিলেন। মেঘনাদবধ তার কাছে হয়ে ওঠে সাহিত্যের শ্রদ্ধার পাঠ্য, ভাষা শেখানোর যন্ত্র নয়। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন-এর বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নে তিনি মেঘনাদবধ থেকে বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন রাখেন, শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাও পড়ান।
নিজ নাটক চিরকুমার সভা-তে মেঘনাদবধ কাব্য-এর প্যারডি ব্যবহার করেন, অনুবাদ করেন মধুসূদনের কবিতা, প্রবন্ধ ও চিঠিতে বারবার তাঁর কথা উল্লেখ করেন শ্রদ্ধাভরে।
রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে বুঝেছিলেন মাইকেলের সত্যিকারের মহত্ব। ১৯৩৫ সালে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন-এ তিনি বলেন,
“মাইকেল সাহিত্যে যে যুগান্তর আনলেন, তার অনতিকাল পরেই আমার জন্ম।… সাহিত্যে তখন যেন ভোরের বেলা—কারো ঘুম ভেঙেছে, অনেকেরই ঘুম ভাঙ্গেনি।”
রবীন্দ্রনাথ নিজের মত ও মনোভাব পুনর্বিবেচনায় নির্ভীক ছিলেন। কেবল মধুসূদনের ক্ষেত্রেই নয়, বহু বিষয়ে তিনি সময়ের সঙ্গে বদলে গেছেন, ভাবনায় সংযোজন করেছেন নতুন সত্য। কিন্তু মধুসূদনের প্রতি তার মনোভাবের এই ব্যাপক রূপান্তর এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বাংলা কবিতার ইতিহাসে একজন শুরু করেছিলেন আধুনিকতার দ্বার উন্মোচন করে, আরেকজন সেই পথকে করেছিলেন মহাকাব্যিক বিস্তার।
মাইকেল ছিলেন বাংলা রেনেসাঁসের প্রথম বিদ্রোহী কবি,
আর রবীন্দ্রনাথ—রেনেসাঁসের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছানো শ্রেষ্ঠ প্রতিভা।
মধুসূদনের সত্যিকার উত্তরাধিকার যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।