সরকার বদলায়, কিন্তু শিক্ষার প্রতি অবহেলা বদলায় না। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে একের পর এক সরকার এসেছে, শিক্ষা কমিশন গঠন হয়েছে, বড় বড় নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। সরকারের রূপ পাল্টেছে, কিন্তু শিক্ষার প্রতি অবহেলা রয়ে গেছে আগের মতোই।
আজকের বাংলাদেশে চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী, দেড় লক্ষাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ১০ লাখের বেশি শিক্ষক রয়েছেন। প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হার ৯৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, মাধ্যমিকেও ভর্তি বেড়েছে। সংখ্যার হিসাবে নিঃসন্দেহে এটি ভালো শোনায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ভর্তি ও পরীক্ষার সাফল্য কি শিক্ষার্থীদের দক্ষ করছে? বাস্তব উত্তর হচ্ছে ‘না’। শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি পাচ্ছে, কিন্তু শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে না। প্রযুক্তি, কারিগরি শিক্ষা, উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা কিংবা বিদেশি ভাষার দক্ষতা—যা আধুনিক চাকরির বাজারে অপরিহার্য—এসব শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারছে না।
কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেনি। বরং শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। শিক্ষা মানোন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা গবেষণায় বিনিয়োগের পরিবর্তে ভরসা করা হয়েছে প্রাইভেট টিউশন, কোচিং আর গাইড বইয়ের ওপর। শিক্ষা বাজেট এর বড় প্রমাণ। ২০১৬–১৭ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ (জিডিপির ২.৪৯ শতাংশ)। ক্রমান্বয়ে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে।
করোনার অভিঘাত এখনো কাটেনি। গণসাক্ষরতা অভিযানের গবেষণায় দেখা গেছে, আগস্ট ২০২৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৪২৭ দিনের মধ্যে ২৭৯ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। অর্থাৎ মাত্র ১৪৮ দিন ক্লাস হয়েছে। দীর্ঘ এই শিক্ষাবিরতি শিশুদের শেখায় ভয়াবহ ক্ষতি করেছে। বিশেষ উদ্যোগ না থাকায় নতুন প্রজন্ম ‘হারানো প্রজন্মে’ পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য দীর্ঘদিনের সমস্যা। শহর বনাম গ্রাম, ধনী বনাম গরিব, সরকারি বনাম বেসরকারি শিক্ষা—সব ক্ষেত্রেই ফারাক বাড়ছে। প্রাথমিক স্তরেই রয়েছে সরকারি স্কুল, মাদ্রাসা, এনজিও স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম—যা শিক্ষার্থীদের মান ও সুযোগের মধ্যে গভীর বৈষম্য তৈরি করছে। সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় কেবল সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরাই অংশ নিতে পারবে। অথচ প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে। এই সিদ্ধান্ত বৈষম্যকে আরও তীব্র করছে।
সরকার পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি–৫) হাতে নিয়েছে এবং ২০২৭ সাল থেকে নতুন পাঠ্যক্রম চালুর পরিকল্পনা করছে। এটি বড় সুযোগ হলেও আশঙ্কাও রয়েছে। পিইডিপি–৪ জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, পরে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবু এখনো এর ১৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এটি আমাদের সক্ষমতার ঘাটতিকে নির্দেশ করে। পিইডিপি–৫-ও যদি একই ধারায় চলে, তবে কোনো বাস্তব পরিবর্তন ঘটবে না।
পিইডিপি–৫ সফল করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে একীভূত করতে হবে। পাঠ্যক্রমকে কর্মসংস্থানমুখী করতে হবে। স্কুল পর্যায় থেকেই প্রযুক্তিশিক্ষা, জীবনদক্ষতা, কারিগরি জ্ঞান ও উদ্যোক্তা হওয়ার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি। সরকার একা এ সংস্কার করতে পারবে না। নাগরিক সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও শিক্ষক সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এনজিওগুলো বহু বছর ধরে শিশুশিক্ষা, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ফিরিয়ে আনা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সহায়তা ও কমিউনিটি স্কুলে কাজ করছে। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। কমিউনিটির অংশগ্রহণও অপরিহার্য। শিক্ষা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি সামাজিক দায়িত্বও। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া শিক্ষায় কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো তরুণেরা ডিগ্রি পেলেও চাকরি পাচ্ছে না, দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। সরকার বদলায়, কিন্তু শিক্ষার প্রতি অবহেলা বদলায় না। এখন সময় এসেছে সত্যিকারের পরিবর্তনের। যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা যায়; যদি সরকার, এনজিও, শিক্ষক সংগঠন ও কমিউনিটি একসঙ্গে কাজ করে এবং বৈষম্য দূরীকরণকে মূল লক্ষ্য বানায়, তবে শিক্ষার ভবিষ্যৎ বদলানো সম্ভব। শিক্ষা শুধু ডিগ্রি নয়, এটি কর্মসংস্থান ও জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি। সেই চাবিকেই শক্ত হাতে ধরতে হবে, না হলে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন কেবল কথার ফুলঝুরি হয়েই থেকে যাবে।