বাংলার লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডার যুগে যুগে সমৃদ্ধ হয়েছে মরমি সাধকদের পদচারণায়। ফকির লালন, হাছন রাজা, রাধারমণ, দূরবীন শাহ, শাহ আব্দুল করিমের মতো মহাসাধকেরা তাঁদের গান ও দর্শনে বাঙালির অন্তরকে ছুঁয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় সমকালীন সময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন আরেক মরমি সাধক—পাগল হাসান। অকাল প্রয়াণে তিনি আজ নেই, তবে তাঁর গান বেঁচে আছে হাজারো ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে।
মোহাম্মদ মতিউর রহমান হাসান, যিনি সর্বজনপ্রিয় পাগল হাসান নামে পরিচিত, জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৫ সালের ১ জুন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলায়। পিতা মুক্তিযোদ্ধা দিলশাদ ও মা আমেনা বেগম। শৈশবেই হারান পিতা ও একমাত্র ভাইকে। সেই দুঃখ তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দিলেও মায়ের স্নেহ ও অনুপ্রেরণাই তাঁকে জীবনের পথে এগিয়ে দেয়। মাকে তিনি আজীবন নিজের মুর্শিদ বলে সম্মান করতেন।
শিমুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হলেও সংসারের দায়ভার নেওয়ায় উচ্চশিক্ষা এগোয়নি। তবে গান ও সুরের প্রতি আকর্ষণ তাঁকে টেনে নিয়েছিল অন্য এক জগতে। শৈশবেই বাবার স্মৃতিকে আঁকড়ে গান গাওয়া শুরু করেন। ২০০৬ সালে সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে প্রথম গান পরিবেশন করেন গুরু দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন দার হাত ধরে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেন।
২০০৮ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর সৃজনশীল যাত্রা। আসিফ আকবর, ডলি সায়ন্তনী, সালমা, কাজী শুভ, গামছা পলাশসহ অনেক খ্যাতিমান শিল্পী তাঁর লেখা ও সুরে গান গেয়েছেন। ব্যান্ড লালন প্রকাশ করেছে তাঁর জনপ্রিয় মৌলিক গান ‘পাগল চিনে না’, ‘রুহানি’ ও ‘পাগলা ঘোড়া’। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। প্রকাশিত গান সত্তরের অধিক এবং নিজের কণ্ঠে প্রকাশিত গান পনেরটিরও বেশি। ‘আসমানে যাইও না’, ‘১, ২, ৩ জীবন খাতা’, ‘আন্ধারপুরীর মানুষ আমি’, ‘মানুষ মইরা গেলে’, ‘মাটির বালাখানা’, ‘ভুলিয়া না যাইও’, ‘সোনা বন্ধুর ভাঙা নৌকা’—এসব গান তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে শ্রোতার হৃদয়ে।
পাগল হাসান ছিলেন সহজ-সরল জীবনদর্শনের অধিকারী। ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে মানুষের ভালো থাকার চিন্তাই ছিল তাঁর প্রাধান্য। জীবনের নানা প্রতিকূলতায় তিনি একসময় ভেঙে পড়লেও আবারও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন গান ও সাধনার শক্তিতে। তাঁর গানে ধরা দিয়েছে দুঃখ, বিরহ, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর ভক্তি।
২০০৬ সালে লুৎফা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। এই সংসারে জন্ম নেয় দুই পুত্র—জিনান ও জিহান। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে করেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী মর্জিনা আক্তারকে।
২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ফেসবুকে প্রোফাইল ছবি সাদা-কালো করে তিনি যেন অমোঘ নিয়তির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পরদিন ১৮ এপ্রিল ভোরে ছাতকের সুরমা সেতু এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই শিল্পী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৮ বছর ১০ মাস ১৬ দিন।
মৃত্যুর পরও তাঁর গান ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে আছে। বিশেষ করে তাঁর কণ্ঠে গাওয়া—
“আন্ধারপুরীর মানুষ আমি, আন্ধার ঘরের বাসিন্দা, ও আল্লাহ… আমি এক পাপিষ্ঠ বান্দা”—গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা অনেকের চোখে জল এনে দেয়।
বাংলার লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডারে পাগল হাসান এক উজ্জ্বল সংযোজন। অকাল প্রয়াণে তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্ম আজীবন বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্পদ হয়ে থাকবে।