আব্দুল কাদির খান—পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচির জনক, যার নাম শুনলেই আজও পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে উঠে আসে গর্বের সুর। ১৯৩৬ সালে ভারতের ভোপালে জন্ম নেওয়া এই পরমাণুবিজ্ঞানী ২০২১ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, রেখে যান এক বর্ণাঢ্য, বিতর্কিত ও ঘটনাবহুল উত্তরাধিকার। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক প্রধান জর্জ টেনেট যাকে ‘ওসামা বিন লাদেনের মতো বিপজ্জনক’ বলেছিলেন, আর ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান শাবতাই শ্যাভিট যিনি তাঁকে হত্যা না করতে পারার আক্ষেপ করেছিলেন—তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ইতিহাসের নির্মাতা।

আব্দুল কাদির খান।
১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ পাকিস্তানের জন্য এক ভয়ানক সংকেত হয়ে আসে। জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন বলেছিলেন, “আমরা ঘাস খাব, তবুও পারমাণবিক বোমা তৈরি করব।” তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন—যখন খ্রিষ্টান, ইহুদি, হিন্দু বোমা থাকতে পারে, তখন একটি ইসলামিক বোমা থাকবে না কেন?
আব্দুল কাদির ১৯৭৪ সালে ইউরোপের ইউরেনকো কোম্পানিতে কাজ করার সময় বিশ্বের সেরা সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তির ব্লুপ্রিন্টে প্রবেশাধিকার পান। এরপর হঠাৎই পাকিস্তানে ফিরে যান এবং গোপনে শুরু করেন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ। তাঁর বিরুদ্ধে পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডসে শিল্প-চুরির অভিযোগ আনা হয়, যদিও কারিগরি কারণে রায় বাতিল হয়ে যায়।
পাকিস্তানে ফিরেই তিনি গড়ে তোলেন রাওয়ালপিন্ডির সেই গোপন গবেষণা কেন্দ্র, যেখান থেকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যাত্রা শুরু হয়।
১৯৮০-এর দশকের শুরুতে ইসরায়েল ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রথমে অনুমোদন দিলেও শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে যান। ১৯৮৭ সালে তাঁর ছেলে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন আবারও এই পরিকল্পনা হয়। সেনাপ্রধান সুন্দরাজি সীমান্তে ৫ লাখ সৈন্য ও শত শত ট্যাংক মোতায়েন করে যুদ্ধ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে রাজীব গান্ধী কৌশলে উত্তেজনা প্রশমিত করেন।
ইসরায়েল চেয়েছিল যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে। ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের টার্গেট করে পাঠানো হয় লেটার বোমা ও ভয়ভীতি। সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে একাধিক হামলার পেছনে মোসাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে দাবি গবেষকদের। কিন্তু আব্দুল কাদির খান ছিলেন অদৃশ্য এক কৌশলী; মোসাদের নজরদারির মধ্যেও তাঁর পরিকল্পনা অপ্রকাশ্য থেকে যায়।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হওয়ায় ওয়াশিংটন গোপনে চোখ বন্ধ করে রাখে। চীন সরাসরি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, ট্রিটিয়াম ও বিজ্ঞানী দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করে। যদিও ১৯৯০ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়।
আব্দুল কাদির খান শুধু পাকিস্তান নয়, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেও গোপনে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাঠাতেন। তিনি তাঁর কেনা যন্ত্রাংশের অতিরিক্ত অংশ বিক্রি করে গড়ে তোলেন এক বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ায় তিনি বোমা বানানোর নকশা ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেন।
২০০৩ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফি এসব তথ্য ফাঁস করে দিলে মার্কিন গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসে। একটি মুরগির খামারের আড়ালে চলা পারমাণবিক স্থাপনার চিত্র পাওয়া যায়। তদন্তে মেলে ড্রাই ক্লিনারের ব্যাগে রাখা পারমাণবিক বোমার নকশা!
২০০৪ সালে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে দায় স্বীকার করেন। দাবি করেন, সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এতে পাকিস্তান সরকার তাঁকে দ্রুত ক্ষমা করে দেয়। প্রেসিডেন্ট মোশাররফ তাঁকে বলেন ‘আমার নায়ক’। যদিও পশ্চিমা চাপে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় ২০০৯ সাল পর্যন্ত।
পাকিস্তানে তিনি ছিলেন জাতীয় নায়ক। তার নামে রাস্তা, স্কুল, এমনকি ক্রিকেট দল পর্যন্ত নামকরণ হয়। টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আমিই বানিয়েছি বোমা, আমিই বানিয়েছি মিসাইল।” তাঁর বিশ্বাস ছিল, মুসলিমদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি থাকতেই হবে। আর সেই প্রযুক্তি অন্য মুসলিম দেশগুলোকে দেওয়া অপরাধ নয়।
আব্দুল কাদির খান বিশ্বাস করতেন, তিনি পাকিস্তানকে শুধু একবার নয়, দুইবার রক্ষা করেছিলেন—একবার বোমা বানিয়ে, আরেকবার সব দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে। তাঁর মৃত্যু হয় ২০২১ সালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁকে অভিহিত করেন “জাতীয় আইকন” হিসেবে।
আজও পাকিস্তানের জনগণের কাছে তিনি একজন কিংবদন্তি, একজন রক্ষক। আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি রয়ে যান বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে—যেখানে তিনি একই সঙ্গে নায়ক এবং খলনায়ক, নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞানী এবং এক ভয়ংকর ছায়া।
✍️ রচনা ও সম্পাদনা: মো: শামীম আশরাফ
📚 উৎস: ঐতিহাসিক দলিল, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও সাক্ষাৎকারভিত্তিক গবেষণা