এসএসসি ফলাফল ২০২৫ প্রকাশিত হয়েছে এবং ফলাফলটি শিক্ষাব্যবস্থার এক গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে বাস্তবধর্মী অবস্থান নিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। অতীতে এসএসসি কিংবা এইচএসসি ফলপ্রকাশ ছিল অনেকটা সরকারের ‘সাফল্য উৎসব’-এর মতো, যেখানে শিক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক প্রচার বেশি গুরুত্ব পেত।
তবে এবারের মূল আলোচনার বিষয়—ফলাফলের হতাশাজনক চিত্র। সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেয় প্রায় ১৪ লাখ ৭৯ হাজার শিক্ষার্থী, যার মধ্যে পাস করেছে মাত্র ১০ লাখ ৬ হাজার ৫৫৪ জন। অকৃতকার্য হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৪৬ জন। পাসের হার ৬৮.০৪ শতাংশ, যা গত বছরের ৮৩.৭৭ শতাংশের তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে কম। মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডসহ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬ লাখ।
এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ব্যর্থতার জন্য শুধুই তাদের দোষ দেওয়া অনুচিত। বরং শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাই এর জন্য বেশি দায়ী। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানীতির ধারাবাহিকতা বারবার ভেঙে গেছে। নতুন কমিশন, নতুন সিদ্ধান্ত—কিন্তু শিক্ষার মৌলিক মানোন্নয়নে বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে কি?
শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানেরা দায় এড়ানোর মতো বক্তব্য দিয়েছেন। যেমন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের মিশন ছিল পরীক্ষা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা।” কিন্তু পরীক্ষার সুন্দরভাবে সম্পন্ন হওয়াই তো তাদের দায়িত্ব, কৃতিত্ব নয়। মূল প্রশ্ন হলো, পাঠদান ও মূল্যায়ন কীভাবে হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির মান কতটা ছিল?
করোনার প্রভাব নিশ্চয়ই একটি বড় কারণ, তবে তা একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। কোভিড-পরবর্তী সময়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ছিল অনিয়মিত ও অনেকক্ষেত্রে দায়সারা। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং সেন্টারে বেশি সময় ব্যয় করে। প্রশ্ন ফাঁস, গাইড বই, এবং মুখস্থ নির্ভর পদ্ধতি—এসবই শিক্ষার গুণগত মান নষ্ট করছে।
এসএসসি ফলাফল ২০২৫ এই বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা, এবং দক্ষতা বিকাশের সুযোগ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের অনেকের শিক্ষাজীবন এখানেই থেমে যেতে পারে। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, বিশেষত মেয়ে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।
শিক্ষায় যে অব্যবস্থাপনা বহুদিন ধরে চলে আসছে, তা কোনো বিশেষ সরকারের নয়—সব সরকারের ব্যর্থতা। গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা সরকারগুলোও শিক্ষার প্রতি যত্নবান ছিল না। সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
শিক্ষার মানোন্নয়নে যা করতে হবে:
সর্বস্তরে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সম্মানজনক বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষা পেশায় উৎসাহিত করতে হবে।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মান ও নিয়মিত মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
পাঠ্যবইসহ সব উপকরণ সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে হবে।
এবং সবচেয়ে জরুরি—শিক্ষায় বাজেট বাড়ানো ও তদারকি জোরদার করা।
এসএসসি ফলাফল ২০২৫ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি কতটা দুর্বল। এই বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ সংকট।