বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিত্ব ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতা দিবস ২০২৫ এর আগে অনলাইনে এক জরিপ পরিচালনা করে তিনি জনগণের কাছে প্রশ্ন তোলেন—“আপনি কি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে প্রকৃত স্বাধীনতা চান?” জরিপে অংশগ্রহণকারীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই মাস্কের প্রস্তাবিত ‘আমেরিকা পার্টি’কে সমর্থন জানায়। মাস্ক ঘোষণা করেন, “আপনাদের স্বাধীনতার জন্য নতুন আমেরিকা পার্টি গঠিত হলো।”
যদিও এই দলটি এখনও ফেডারেল ইলেকশন কমিশনের নিবন্ধন ছাড়াই গঠন হয়েছে, নিবন্ধন একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, মাস্ক চাইলে দল গঠন করা কঠিন নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে হয়, যেখানে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মোট ৫৩৮ ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে কমপক্ষে ২৭০ ভোট প্রয়োজন জয়ী হওয়ার জন্য। কোনো রাজ্যে যে দল সবচেয়ে বেশি ভোট পায়, ঐ রাজ্যের সমস্ত ইলেক্টোরাল ভোট পায় সেই দল। ফলে, একক বা তৃতীয় কোনো দলের পক্ষে ছোট ছোট রাজ্যে ভোট জিতে পুরো দেশের ইলেক্টোরাল ভোটে আধিপত্য বিস্তার করা প্রায় অসম্ভব।
নির্বাচনী ব্যবস্থার এই কাঠামোর কারণে, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের বাইরে তৃতীয় কোনো দল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারেনি। ২০০০ সালের নির্বাচনে আল গোর এবং ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন মোট ভোটে এগিয়ে থেকেও ইলেক্টোরাল ভোটের ব্যবধানের কারণে পরাজিত হয়েছেন।
তৃতীয় দলের সদস্য কংগ্রেস ও সিনেটে নির্বাচিত হওয়া কিছুটা সম্ভব, যা ভোটের ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প সরকারের ‘এ বিগ বিউটিফুল বিল’ পাস হওয়ার সময় ভাইস প্রেসিডেন্টের একক ভোটে বিলটি গৃহীত হয়েছিল। মাস্কের দলের সদস্যরা যদি সেখানে অবস্থান করে, তারা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ধারক শক্তি হতে পারে।
মাস্ক মার্কিন নাগরিক না হওয়ায় সংবিধান অনুসারে কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে বিপুল অর্থায়ন ও প্রচার দিয়ে জয়ী করলেও, পরবর্তীতে ‘এ বিগ বিউটিফুল বিল’ নিয়ে মাস্ক ও ট্রাম্পের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
মাস্ক দাবি করেন, বিলটি সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করবে এবং ডিওজিই-র মাধ্যমে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে। তবে ট্রাম্প বিল পাসে অটল ছিলেন। একই সঙ্গে, মাস্কের সুপারিশে নাসার প্রধানের নিয়োগ বাতিল করা হয় এবং টেসলা-স্পেসএক্সের করছাড় বাতিলের হুমকিও দেওয়া হয়েছে, যা মাস্কের স্বার্থে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
মার্কিন রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দল ছাড়াও লিবার্টিরিয়ান, গ্রিন, পিপলস, ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টি ইত্যাদি ছোট দল রয়েছে। তবে সংগঠন ও প্রচারণার দুর্বলতায় তারা বৃহৎ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ২০২২ সালে ‘ফরোয়ার্ড পার্টি’ নামে নতুন একটি দল গঠিত হলেও তারা ব্যাপক সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি।
ধনী প্রার্থী রস পেরো ১৯৯২ সালে ১৯% ভোট পেলেও কোনো ইলেক্টোরাল ভোট পায়নি, যা মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থার তৃতীয় দলের জন্য বড় বাধা।
মাস্কের নতুন দল গঠনের ঘোষণা তার ট্রাম্প-বিরোধী মনোভাব প্রকাশের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বের প্রকাশ। ট্রাম্প তাকে ‘লাইনচ্যুত ট্রেন’ বলে সমালোচনা করেছেন। যদিও তিনি কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবেন না, কিন্তু বৃহৎ অর্থায়ন ও সংগঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করাই লক্ষ্য।
মার্কিন গণতন্ত্র বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও জবাবদিহিতার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা কঠোর নিয়মনীতি ও নাটকীয়তার মধ্যেও টিকে রয়েছে। মাস্কের নতুন দল যতই উচ্চমূল্যের উদ্যোগ হোক, বাস্তবে এটি দ্বিদলীয় আধিপত্য ভাঙতে বা প্রেসিডেন্ট পদ জয় করতে সক্ষম হবে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ।
ইলন মাস্কের রাজনৈতিক দলের ঘোষণা ও কার্যক্রম মূলত একটি বিলাসী স্বপ্ন কিংবা স্বার্থের দ্বন্দ্বের ফল। মার্কিন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ধরনের নতুন দলের আসল প্রভাব সীমিত। তবে কংগ্রেস ও সিনেটে নির্দলীয় বা তৃতীয় দলের সদস্যদের মাধ্যমে সামান্য প্রভাব বিস্তার সম্ভব হলেও, প্রেসিডেন্ট পদে আসার জন্য বৃহৎ জাতীয় সংগঠন, প্রচারণা ও সময় প্রয়োজন, যা বর্তমানে মাস্কের জন্য কঠিন।