সীমান্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক অপার সৌন্দর্য—বাংলাদেশের শেষ পাহাড়ি রেখা, মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা মধুটিলা ইকোপার্ক। এই জায়গাটিতে পৌঁছানো মানেই যেন সময়ের ঘূর্ণিপাকে ফিরে যাওয়া—যেখানে নেই শহরের হর্ন, নেই মানুষের কোলাহল। আছে কেবল সবুজের নৈঃশব্দ্য, হাতির পায়ের ছাপ, জংলি গন্ধ আর পাহাড়ি হাওয়ার নির্মল ছোঁয়া।

আমরা কয়েকজন বন্ধু, শহরের ক্লান্তি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম এক পাহাড়ি অভিযানে। গন্তব্য—মধুটিলা ইকোপার্ক, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলায় অবস্থিত। আর এই ভ্রমণ যে আমাদের জীবনের অন্যতম রোমাঞ্চে পরিণত হবে, তা তখন ভাবিনি।


🚌 ভোরের যাত্রা: ইট-কাঠের শহর ছেড়ে

ঢাকা থেকে রাতের বাসে রওনা দিয়ে ভোরবেলা পৌঁছাই শেরপুর শহরে। সেখান থেকে সিএনজি ও টমটমে করে রওনা দেই নালিতাবাড়ির পোড়াগাঁওয়ের পথে। রাস্তার দুইপাশে ধানখেত, মাঝেমধ্যে গারো শিশুদের উচ্ছ্বাসভরা দৌড়, আর দূরে পাহাড়ের গা ছুঁয়ে সূর্য ওঠার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়।

প্রবেশদ্বারে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড—“মধুটিলা ইকোপার্ক”। আর তখন থেকেই শুরু হয় আসল অ্যাডভেঞ্চার।


🏞️ প্রকৃতির পরতে পরতে চমক

ইকোপার্কে ঢুকতেই প্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়ে তা হলো সারি সারি লম্বা গাছ, যেগুলোর মাঝখান দিয়ে ঢালু একটি রাস্তা পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে। রাস্তার পাশে স্থানীয় পাহাড়িদের পণ্যের দোকান—সুন্দর হাতের তৈরি বাঁশের পাখা, মধুর বোতল, কাঠের অলংকার, আর চিবিয়ে খাওয়ার একধরনের গারো মশলা!

আরো একটু এগোতেই চোখে পড়ে হাতি, হরিণ, বানর, কুমির, এমনকি ক্যাঙ্গারুর প্রতিকৃতি। তবে এগুলো কেবল শুরুর অর্ধেক। সত্যিকারের রোমাঞ্চ তখনো বাকি!


🌲 জংগলের গভীরে: হারিয়ে যাওয়া ও হাতির হুমকি

আমরা একটি ছোট ট্রেইলে ঢুকে পড়লাম। যত এগোই, তত গভীর বন। পাখির ডাক, পাতার মচমচ শব্দ আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত অজানা শব্দ—যেন কারও নজরে আছি। গাইড জানাল—“ভাগ্য খারাপ হলে বন্য হাতির সামনে পড়তে পারেন!” আমরা হাসতে হাসতে বিষয়টি উড়িয়ে দিলেও, কিছুদূর যেতেই এক জায়গায় গাছের গুঁড়ি ভেঙে পড়ে আছে, যেন বিশালকায় কারও পদচিহ্ন।

পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। মোবাইলে নেট নেই। একসময়ে বাঁশের লাঠি দিয়ে সাপ তাড়াতে তাড়াতে রাস্তা খুঁজছিলাম। জুতো ভিজে কাদায় আটকে যায়, পোকার কামড়ে বন্ধুর পা ফুলে ওঠে। একবার মনে হলো—আমরা কি ফিরে যেতে পারবো?


📸 টাওয়ারে ওঠার রোমাঞ্চ ও ভারত দর্শন

একটি কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা উঠলাম প্রায় ৩৫০ ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মিত একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। হাওয়ার গতি বেড়ে গিয়েছিল, দোলা দিচ্ছিল কাঠের টাওয়ারটিকে। সবার পা থমকে গেলেও আমি উঠলাম উপরে।

সেখানে দাঁড়িয়ে দূরের মেঘালয়ের পাহাড়, ভারতের সীমান্ত চেকপোস্ট আর সবুজ টিলার সারি দেখে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছিল—পৃথিবী থেমে গেছে এখানে।


🍽️ অতিথেয়তার গল্প: পাহাড়ি ডিম-ডালের স্বাদ

দুপুর গড়িয়ে গেছে, ক্ষুধা তীব্র। পার্কের পাশে স্থানীয় একটি গারো পরিবারের বাড়িতে যাই। প্রথমে বললেন, “এইতো ভাইজান, থালা কম, সবাই একসাথে খাই কিভাবে?” আমরা বললাম, “আচ্ছা, কলাপাতা পেলেই চলবে।”
মুহূর্তের মধ্যে এক পাহাড়ি বাচ্চা পাশের বাড়ি থেকে থালা নিয়ে এলো। ডাল, ডিম, ভাত আর ভালোবাসা মিশে এমন এক স্বাদ তৈরি করল যা কোনো রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় না।


🍯 মধুটিলার “মধুর” গল্প

গভীর জঙ্গলে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি বিশাল মধুর চাক! স্থানীয়রা বললেন, “এই জন্যই তো জায়গার নাম মধুটিলা।” বন ও মধু এখানে একত্রে বাস করে। আমরা চেষ্টা করেও ছবি তুলতে পারিনি কারণ চাকের নিচেই গাছের শিকড় ধরে একটি অদ্ভুত ধরনের বানর বসে ছিল।


🧳 ফেরার সময়: হৃদয়ে রেখে যাওয়া বন

দিন শেষে ফেরার পথে ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে হঠাৎ একজন বন্ধুর লেখা চোখে পড়লো—“তুমি আসতে পারোনি, কিন্তু মনে রেখেছি তোমায়।” প্রকৃতির মাঝেও বন্ধুত্ব এত স্পষ্ট হয়! সেই স্মৃতির ব্যাগভর্তি ভালোবাসা নিয়ে আমরা ফিরে আসি শেরপুর শহরে।


ℹ️ ভ্রমণ তথ্য:

  • লোকেশন: মধুটিলা, নালিতাবাড়ি, শেরপুর

  • প্রবেশ ফি: ১০ টাকা

  • পার্কিং ফি: মোটরসাইকেল–২০ টাকা, সিএনজি–৫০ টাকা, মাইক্রোবাস–১০০ টাকা, বাস–২০০ টাকা

  • রেস্ট হাউজ: “মহুয়া” (৪ কক্ষ বিশিষ্ট, ৬,৯০০ টাকা/দিন)

  • যোগাযোগ: মধুটিলা রেঞ্জ অফিস / শেরপুর বন বিভাগ

  • উপযুক্ত সময়: অক্টোবর-মার্চ, বিশেষ করে শীতকালে


🎒 শেষ কথাঃ

মধুটিলা ইকোপার্ক শুধু একটি ভ্রমণের জায়গা নয়, এটি এক প্রাকৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে শেখা যায় কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করা যায়, কীভাবে সাধারণ মানুষের হৃদয় এত বিশাল হয় আর কীভাবে পাহাড়-জঙ্গল আমাদের শহুরে ক্লান্তি মুছে দিয়ে নতুন মানুষ করে তোলে।

চলুন, প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাই। আপনার পরবর্তী গন্তব্য হোক মধুটিলা।