আমি বরিশালে যাচ্ছি—শুধু ঘুরতে নয়, সম্ভাবনার সন্ধানে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এই শহরটির প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে অনেক আগে, কিন্তু এবার পরিকল্পনা ভিন্ন। আমি দেখতে চাই, এই নদীমাতৃক অঞ্চলটি কীভাবে হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের পর্যটনের পরবর্তী গন্তব্য।

The Silent Beauty of Barishal on the Waters of Kirtonkhola
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পার হয়ে পথ ধরলাম বরিশালের দিকে। আগে যেখানে বারবার নৌকা আর ফেরি বদল করতে হতো, আজ উন্নত সড়ক ও সেতুর কারণে যাত্রাটা হয়ে উঠেছে স্বাচ্ছন্দ্যময়। দূরের গ্রামের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি, দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট খাল—সব মিলে এক অদ্ভুত শান্তি।
বরিশালে পৌঁছে প্রথম গন্তব্য গুঠিয়া মসজিদ—বায়তুল আমান। চোখ ধাঁধানো বিশালতা আর সুচারু নকশায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। পাশে ২৫ একরের সূর্য দিঘি, যেখানে পাখির কলরব আর জলতরঙ্গ একসাথে মনের ক্লান্তি মুছে দেয়।

গুঠিয়ার সবুজে ঘেরা পবিত্র নীরবতা—বায়তুল আমান জামে মসজিদ
সেদিন দুপুরে আমি রওনা দিলাম স্বরূপকাঠির ভাসমান পেয়ারাবাগানের দিকে। নৌকায় ভেসে পেয়ারার বাগানের ভেতর দিয়ে চলার অভিজ্ঞতা… এক কথায় বললে, যেন জলের ওপর সবুজ স্বপ্ন। বাংলাদেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারাবাগান—যেখানে গ্রীষ্ম ও বর্ষার ছোঁয়ায় প্রকৃতি যেন তার শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য উজাড় করে দেয়।
এখান থেকেই আমার মাথায় নতুন ভাবনার জন্ম: বরিশালের নদ-নদী ও খালগুলোর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য কেরালার মতো হাউসবোট চালু করা যায় না?
কেরালার গল্প, বরিশালের বাস্তবতা
দক্ষিণ ভারতের কেরালায় যেসব বড় বড় ধানবাহী নৌকা একসময় অকেজো হয়ে পড়েছিল, আজ সেই নৌকাগুলোই ‘হাউসবোট’ রূপে ফিরেছে, শত শত পর্যটকের স্বপ্নযাত্রার বাহন হয়ে। নদীর বুক চিরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। কেউ দিনের ভ্রমণে আসে, কেউবা রাতে থেকেও যায় এই ভাসমান আবাসে।
সেই কেরালার অভিজ্ঞতাকে আমরা বরিশালের পটুয়াখালী, বরগুনা, কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা বা সুগন্ধা নদীতে কীভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি—ভাবনায় চলে আসে। ঐতিহ্যবাহী চালতি নৌকা, পালতোলা তরি, কোষা নৌকার নকশায় আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া দিয়ে তৈরি হাউসবোট—যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মোহিত করবে।
হাউসবোট ভ্রমণ হতে পারে বরিশালের পরবর্তী ব্র্যান্ড
ভাবুন তো, সকালে উঠে নৌকার ডেকে দাঁড়িয়ে চারপাশে কুয়াশাচ্ছন্ন নদী আর পাখির ডাক শুনছেন! তারপর পেয়ারাবাগান ঘুরে দুপুরে স্থানীয় পান্তা-ইলিশ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ। সন্ধ্যায় গানে-নাচে ভরা লোকজ আয়োজন আর রাতে ডেকের ওপর শুয়ে তারা দেখা।
এখানে থেমে নেই বরিশালের পর্যটন সম্ভাবনা। শেরেবাংলা স্মৃতি জাদুঘর, লাকুটিয়া জমিদারবাড়ি, কুয়াকাটায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত কিংবা ফাতরার বনের বন্যপ্রাণী—সবই হাউসবোট ভ্রমণের একেকটি অভিজ্ঞতা হতে পারে।
উদ্যোক্তাদের জন্য এক নতুন দিগন্ত
আমি যখন বরিশালের নদীতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল—এই প্রকৃতি কেবল উপভোগ করার নয়, এই সৌন্দর্যের মাঝে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। হাউসবোট একটি প্রিমিয়াম পর্যটন পণ্য। পরিবেশবান্ধব, দীর্ঘমেয়াদি আয়ক্ষম, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে এটি।
যারা নতুন কিছু করতে চান, তাদের জন্য এখনই সময়। বাজার বিশ্লেষণ করে ছোট পরিসরে কয়েকটি হাউসবোট দিয়ে শুরু করুন। দেশীয় নৌকার নকশায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করুন। কারিগর, প্রকৌশলী ও ডিজাইনারদের নিয়ে টিম তৈরি করুন।
বরিশালকে ঘিরে হাউসবোটভিত্তিক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারে শুধু আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
শেষ কথা:
বরিশালের নদী, খাল, জলাশয় শুধু জল নয়—এগুলো সম্ভাবনার স্রোত। ভেসে বেড়ানো এক টুকরো স্বপ্ন হতে পারে এই হাউসবোট। আমরা যদি এখনই এগিয়ে আসি, তবে বরিশাল একদিন হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার নদীমাতৃক পর্যটনের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।