টাঙ্গুয়ার হাওরের জলরাশি যখন ঢেউয়ে ঢেউয়ে ছুটে আসে, ঠিক তখনই শহর থেকে আসা আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে থাকি। বাতাসে আমাদের জামা উড়ে যায়, আর চোখের সামনে শুধু পানি আর পানি। কত পাখি উড়ছে, দূরে গাছের ফাঁকে দেখা যায় একটা নৌকা। হাওরের সৌন্দর্য এক অন্যরকম আবেশ তৈরি করে, যা শহরের কোলাহল থেকে মুক্তির এক নিঃশব্দ ডাক।
প্রকৃতির গহীনে হারিয়ে যাওয়ার এক নাম—টাঙ্গুয়ার হাওর।
আমরা এসেছি টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে। পরিকল্পনা ছিল অনেক দিনের, বাস্তবায়ন হলো এই বর্ষায়। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ, সেখান থেকে তাহিরপুর, এরপর ট্রলারে চড়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। চারপাশে কেবল জল আর আকাশ, মাঝে মাঝে কিছু গাছপালা আর ছায়াঘেরা ছোট ছোট বসতি। আমরা ছাদে বসে গান শুনি, কেউ কেউ ছবি তোলে, আবার কেউ হাওরের জল ছুঁয়ে দেখে।
ট্রলারে রান্নার ব্যবস্থা ছিল। দুপুরে ভাত, ডাল, ছোট মাছ ভাজি আর ডিম ভুনা খাওয়া হলো। খাবারের মাঝে হাওরের একটা স্বাদ থাকে—যা শহরের কোনো দামি রেস্টুরেন্টে মেলে না। খাবার শেষে সূর্যের আলো একটু ঢলে পড়েছে, তখনই পরিচয় হলো ছেলেটার সঙ্গে। নাম জাহিদ। বয়স খুব বেশি না, হয়তো ১৩/১৪। পরনে একটি ছেঁড়া পাঞ্জাবি, পায়ে জুতা নেই, কিন্তু মুখে হাসি। আমাদের ট্রলারের কাছেই তার নৌকায় সে মাছ ধরছিল।
জিজ্ঞেস করলাম, “পড়াশোনা করো?”
সে একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “না ভাই, স্কুল ছাড়তে হইছে।”
“কেন?”
“ঘরে খাবার নাই, বাবা অসুস্থ। আমি মাছ ধরে বিক্রি করি। যা পাই, তা দিয়েই সংসার চলে।”
আমাদের কারও মুখে তখন আর কথা ছিল না। হাওরের সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে হঠাৎই একটা বাস্তবের ঝড় এসে পড়ল আমাদের হৃদয়ে। আমরা যে আনন্দ নিতে এসেছি, সেই আনন্দের পেছনেই জড়িয়ে আছে এই ছেলেটার কঠোর বাস্তবতা।
সেদিন আমরা অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম জাহিদের সঙ্গে। ওর চোখে ছিল স্বপ্ন—যদিও বাস্তবতা খুব কঠিন। বলেছিল, “আমি বড় হইলে একটা বড় মাছের খামার করব, আবার স্কুলেও যাবো।” আমরা ওকে কিছু শুকনো খাবার আর একটু টাকা দিলাম, ও হাসলো। সেই হাসিতে ছিল কৃতজ্ঞতা, কিন্তু আরও ছিল স্বপ্নের ঝিলিক।
আমরা এরপর নীলাদ্রি লেক, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ঘুরে আবার ফিরে আসি। কিন্তু জাহিদের মুখ, ওর কথা, ওর সংগ্রাম বারবার মনে পড়ে। হাওরের জলরাশি যেমন বিশাল, তেমনি বিশাল এই অঞ্চলের মানুষের সংগ্রাম। পর্যটক হিসেবে আমরা কেবল সৌন্দর্য দেখি, কিন্তু এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা কঠিন জীবনটা প্রায়শই অদৃশ্য থেকে যায়।
হাওরের ছেলেটা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, শুধু উপভোগ নয়—দায়িত্বও নিতে হয়। ভবিষ্যতে যদি কখনো আবার যাই হাওরে, আমি জাহিদের খোঁজ নেব। হয়তো তখন সে আবার স্কুলে ফিরে গেছে, হয়তো একটা খামার দিয়েছে—আর হয়তো এখনো হাওরের বুকে জীবনযুদ্ধে লড়ছে।
এই গল্প শুধু জাহিদের নয়, হাজারো হাওরপারের সন্তানের, যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝেও লড়ে যায় জীবনের জন্য।