গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য যিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। জন্মগ্রহণ করেন ঝালকাঠির রাজাপুর থানার সাতুড়িয়া গ্রামে, যদিও তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল পটুয়াখালীর বাউফলে। শিক্ষাজীবন কাটে বরিশাল জেলা স্কুল, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯১৬ সালে মুসলিম লিগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি, আর পরের বছর ১৯১৭ সালে হন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। ইতিহাসে একমাত্র তিনিই, যিনি একসঙ্গে এই দুই বিরোধী রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯১৮-১৯ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনের সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দেন জমিদারি প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করবেন। এতে ভীত জমিদারেরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান, কিন্তু কৃষকরা তাদের নেতা হিসেবে শেরেবাংলাকেই বেছে নেন।
প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা, মুসলিম এডুকেশন ফান্ড গঠন, এবং মাধ্যমিক শিক্ষা আইন প্রণয়ন—এসবই তাঁর উদ্যোগে হয়। বরিশালের চাখার কলেজ, আদিনা কলেজ, মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজ, কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, ঢাকার ইডেন কলেজ, বেকার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল ও ফজলুল হক মুসলিম হল তাঁর শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান বহন করে।
তিনি ছিলেন একজন সাহসী বক্তা ও চিন্তাবিদ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনি বারবার উৎসাহ দিয়েছেন। একবার বলেছিলেন, “যে জাতি তার সন্তানদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা কখনো সিংহের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবে না।”
১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে তিনি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা পাকিস্তান গঠনের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনগণ বিপুলভাবে ভোট দেয়, এবং ফজলুল হক প্রধান মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেন, একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন, শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করেন, পয়লা বৈশাখকে ছুটির দিন ঘোষণা করেন, এবং বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমি হিসেবে গড়ে তোলেন। জমিদারি ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলুপ্তিতে তাঁর নেতৃত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণে বলেন, “ফজলুল হক মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙালি এবং খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙালিত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের এমন সুন্দর মেলবন্ধন আমি আর কোথাও দেখিনি। এ সমন্বয়ই ভবিষ্যতের বাঙালি জাতিসত্তার পথপ্রদর্শক।”
জীবনের বিভিন্ন সময় তিনি বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ অসাধারণ মানুষটি ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল পরলোকগমন করেন। তিনি চিরকাল বাঙালির প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।